আগামী অর্থবছর থেকে কর রেয়াতের পরিমাণ কমিয়ে আনতে যাচ্ছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এ নিয়ে ইতোমধ্যে এনবিআর কাজ শুরু করেছে বলে সংস্থাটির একটি সূত্র জানিয়েছে।
গত ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে বিভিন্ন ধরনের কর রেয়াত বা কর অব্যাহতির কারণে সরকার এক লাখ ৭৮ হাজার ২৪২ কোটি টাকার রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হয়েছে। ২০২০-২০২১ অর্থবছরে এই কর রেয়াতের পরিমাণ ছিল এক লাখ ২৫ হাজার ৮১৩ কোটি টাকা। ফলে এক বছরের ব্যবধানে কর অব্যাহতির পরিমাণ বেড়েছে ৫২ হাজার ৪২৮ কোটি টাকা। শতকরা হিসেবে যা ৪২ শতাংশ।
কর অব্যাহতিকে আক্ষরিক অর্থে বলা হয় ‘প্রত্যক্ষ কর ব্যয়’ বা ডিরেক্ট ট্যাক্স অ্যাক্সপেনডিচার। প্রত্যক্ষ কর ব্যয়ের বিশালত্বের কারণে দেশের কর-জিডিপি’ হার বাড়ানো সম্ভব হচ্ছে না বলে মনে করে অর্থ মন্ত্রণালয় ও অর্থনীতিবিদরা।
প্রত্যক্ষ কর ব্যয় বিষয়ে অর্থমন্ত্রী তার ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় তিনটি প্যারাগ্রাফ বরাদ্দ করেছেন। তাতে তিনি উল্লেখ করেছেন, ‘প্রত্যক্ষ কর ব্যয়’ বলতে রেয়াত, ছাড়, অব্যাহতি, হ্রাসকৃতহারে করারোপ এবং মোট করযোগ্য আয় পরিগণনা থেকে আয় বাদ দেওয়াকে বোঝায়। এটি এক ধরনের ভর্তুকি। অর্থাৎ, এই ভর্তুকি যদি কর হিসেবে আহরিত হতো তাহলে মোট আহরিত করের সঙ্গে এটি যুক্ত হতো এবং করের পরিমাণ বৃদ্ধি পেতো। তবে, প্রত্যক্ষ কর ব্যয়ের মাধ্যমে অর্থনৈতিক প্রণোদনা, সামাজিক সাম্যব্যবস্থা ও শিল্প সহায়তার সঙ্গে সামগ্রিক কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয় বলেও অর্থমন্ত্রী মন্তব্য করেছেন।
এ বিষয়ে অর্থ বিভাগের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বর্তমান অর্থবছরে নির্বাচনী বিষয় বলে কর রেয়াতের পরিধি কমানোর কথা চিন্তা করা যাচ্ছে না। কিন্তু আগামী অর্থবছর থেকে বেশ কয়েকটি খাত থেকে কর রেয়াত বা কর অব্যাহতি বা কমানো হবে। যদি ১০ হাজার কোটি টাকা এ খাত থেকে বাঁচাতে পারা যায়, তবে তা সামাজিক সুরক্ষা খাতে ব্যবহার করা যাবে।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ২০২০-২০২১ অর্থবছরে প্রত্যক্ষ কর ব্যয় প্রাক্কলিত এক লাখ ২৫ হাজার ৮১৩ কোটি টাকার মধ্যে করপোরেট পর্যায়ে কর রেয়াত ছিল ৮৫ হাজার ৩১৪ কোটি টাকা। এবং ব্যক্তিগত পর্যায়ে যা ছিল ৪০ হাজার ৪৯৯ কোটি টাকা। সামগ্রিকভাবে, ২০২০-২০২১ অর্থবছরের জন্য এই প্রত্যক্ষ করব্যয় বা কর রেয়াতের পরিমাণ ছিল মোট জিডিপির ৩ দশমিক ৫৬ শতাংশ।
চলতি ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের প্রক্ষেপিত মোট জিডিপির আকার বিবেচনায় নিয়ে ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে প্রক্ষেপিত প্রত্যক্ষ করব্যয়ের মোট পরিমাণ দাঁড়াবে এক লাখ ৭৮ হাজার ২৪১ কোটি টাকার ঘরে। আবার এর সঙ্গে প্রাক্কলিত ভর্তুকির পরিমাণ যোগ করলে এর পরিমাণ হবে ২ লাখ ৮৯ হাজার ২২৮ কোটি টাকা।
তবে অধিকাংশ কর অব্যাহতি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ও ব্যবসায়ীদের সুবিধার জন্য দেওয়া হয় বলে মনে করেন এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন। তিনি অর্থনৈতিক সাংবাদিকদের সংগঠন ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, রাজনৈতিক অর্থনীতির কারণে এনবিআর রাজস্ব আয়ে পিছিয়ে আছে। রাজস্ব আয় বাড়াতে এখন বড় বাধা রাজনৈতিক অর্থনীতি। কারণ অনেক খাতেই কর অবকাশ সুবিধা দিতে হচ্ছে। বিশেষ কর হার আরোপ করতে হচ্ছে। তা ছাড়া সংসদ সদস্যদের অনেকেই ব্যবসায়ী হওয়ায় তারাও কর ছাড়ের সুবিধা নিতে চাইছে। এসব কারণে বছরে আড়াই লাখ কোটি টাকা কর ছাড় দিতে হচ্ছে। এসবই রাজনৈতিক অর্থনীতির স্বার্থের দ্বন্দের কারণে কাক্ষিত রাজস্ব আয় হচ্ছে না। ’
এদিকে কর-জিডিপির হার বাড়ানোর ক্ষেত্রে কর অব্যাহতি অন্যতম প্রতিবন্ধক বলে মন্তব্য করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। তিনি জাতীয় সংসদে দেওয়া তার বাজেট বক্তৃতায় বলেছেন, অপরিহার্য কারণ ছাড়া আমরা কর অব্যাহতির কোনো এসআরও (বিধিবদ্ধ আইনি প্রজ্ঞাপন) জারি করা পরিহার করব। এর ফলে রাজস্ব ঘাটতি কমে যাবে এবং রাজস্ব ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা আসবে। অব্যাহতি প্রাপ্ত খাত থেকে কর আদায় করা হলে, প্রকৃত কর-জিডিপি অনুপাত অনেকাংশে বৃদ্ধি পাবে। ’
বাংলাদেশে এখন কর-জিডিপির হার ৯ শতাংশের ঘরে আটকে আছে। যেমন-২০০৮-২০০৯ অর্থবছরে এই হার ছিল ৯ দশমিক ২ শতাংশ। ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে তা এসে দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৭ শতাংশে। ফলে ১৪ বছরের ব্যবধানে কর-জিডিপির হার বেড়েছে মাত্র ০.৫ শতাংশ। অন্যদিকে দক্ষিণ এশিয়ার অধিকাংশ দেশে এই হার ১৫ থেকে ২৫ শতাংশের ঘরে রয়েছে।
আপনার মতামত লিখুন :