শত প্রতিকূলতা তাকে দমিয়ে রাখতে পারেনি


admin প্রকাশের সময় : জানুয়ারী ২, ২০২৪, ৫:১৭ পূর্বাহ্ন /
শত প্রতিকূলতা তাকে দমিয়ে রাখতে পারেনি

রাইজিংবিডি থেকে নেওয়া

রাজনীতি ও শিক্ষা, সংস্কৃতি ও খেলাধুলা, অধিপরামর্শ ও সক্রিয়তা এবং স্বাস্থ্য ও বিজ্ঞান-এই চার ক্যাটাগরিতে বিশ্বের প্রভাবশালী ১০০ নারীর তালিকা প্রকাশ করেছে বিবিসি। চলতি বছরের এই তালিকায় স্থান পেয়েছেন বাংলাদেশের জান্নাতুল ফেরদৌস আইভি। শত প্রতিকূলতা পেরিয়ে তার আজকের এই সফলতা অর্জনে ছিল অদম্য ইচ্ছা শক্তি। তার এই দীর্ঘ পথচলার অভিজ্ঞতা নিয়ে কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রাইজিংবিডির নিজস্ব প্রতিবেদক রায়হান হোসেন

 

রাইজিংবিডি: আপনার শৈশবের বেড়ে ওঠা ও শিক্ষা জীবন কেমন ছিল?
জান্নাতুল ফেরদৌস আইভি: আমার জন্ম হয়েছে খুলনায়। আমি খুলনায় প্রাইমারি স্কুল থেকে শুরু করে অনার্স প্রথম বর্ষ পর্যন্ত খুলনায় পড়াশুনা করি। দুর্ঘটনার পর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বেসরকারি ব্যবস্থায় ডিগ্রি পরীক্ষায় অংশ নিই। তারপর ইডেন কলেজ  থেকে ২০০১ সালে সমাজবিজ্ঞান বিভাগে স্নাতক ডিগ্রি ও ২০০৫ সালে ইংরেজি সাহিত্যে মাস্টার্স করি। এরপর ২০০৯ সালে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভেলপমেন্ট স্টাডি বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রির পাশাপাশি ২০১০ সালে একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলবি ডিগ্রি ও ২০১২ সালে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট থেকে সোশ্যাল কমপ্লায়েন্স বিষয়ে ডিপ্লোমা  সম্পন্ন করেছি।

রাইজিংবিডি: আপনার দুর্ঘটনাটা কীভাবে ঘটেছিল?
জান্নাতুল ফেরদৌস আইভি: দুর্ঘটনটি ঘটেছিল ১৯৯৭ সালের ৩০ এপ্রিল। যখন আমি ঈদের ছুটিতে বাসায় গিয়েছিলাম। এটা কোনো সহিংসতা ছিল না। আমি রান্না করতে গিয়ে অসাবধানতাবশত আমার পোশাকে আগুন লেগে যায়। পেছনে তাকিয়ে দেখি, কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমার দুই হাত, গলা, মুখ পুড়ে শেষ। যাতে আমার শরীরের ৬০ শতাংশ পুড়ে যায়। তারপর থেকে আমার জীবন ভিন্নমাত্রায় চলে যায়। আমি বাঁচবো কিনা সেই আশঙ্কায় ছিলাম। দ্বিতীয় তো বেঁচে উঠার পরে সেই ৬০ শতাংশ জায়গা কুঁচকে গিয়েছিলো।

 

রাইজিংবিডি: আপনার চিকিৎসার সময় প্রতিকূলতা কী ছিল?
জান্নাতুল ফেরদৌস আইভি: আমরা একটি সচ্ছ্বল পরিবার ছিলাম। কিন্তু চিকিৎসা প্রচুর ব্যয়বহুল। আমার এই চিকিৎসার ব্যয়বার গ্রহণ করতে গিয়ে বাবা-মা একেবারে নিঃস্ব হয়ে গিয়েছিলেন। বাবা মায়ের চাওয়া ছিল যে আমাকে বাঁচিয়ে তুলবে। কিন্তু অন্যদিকে টাকার কষ্ট। আমার চিকিৎসার ক্ষেত্রে আত্মীয়-স্বজনের ভূমিকা অনেক বেশি ছিল। আমার জীবনে বড় একটি অংশ হলো চিকিৎসার ব্যয়ভার। সেটা তখনও কষ্টকর ছিল কিন্তু এখন আমি যেহেতু নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছি তাই কারো সাহায্য লাগে না। দীর্ঘ এই সাড়ে ২৬ বছর আমার পঞ্চাশ বারের বেশি সার্জারি হয়েছে।

রাইজিংবিডি: কেন মানবাধিকারকর্মী হতে চেয়েছিলেন?
জান্নাতুল ফেরদৌস আইভি: আমি ছোটবেলা থেকে শিক্ষক হতে চেয়েছিলাম। কিন্তু যখন শরীরের ৬০ শতাংশ পুগে গিয়েছিল তখন বুঝতে পেরেছিলাম যে আমার আর শিক্ষক হওয়া সম্ভব হবে না। তখন আমার বোন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিষয়ে পড়াশোনা করতো, ও যখন আন্তর্জাতিক আইন, জাতিসংঘের ভূমিকা পড়তো তখন আমি ওকে একদিন জিজ্ঞেস করি যে এমন কোনো সংস্থা নেই যে আমাদের মতো মানুষদের নিয়ে কাজ করে। ও বলল, হ্যাঁ আপু আছে। এনজিওদের কাজ কি ও যখন বুঝিয়ে দিত তখন থেকেই মনে হতো আমি একজন মানবাধিকারকর্মী হবো।

 

কিন্তু মানবাধিকার কর্মী যে একটি পূর্ণ পেশা তখনও আমি সেটা জানতাম না। আমি ভাবতাম এটা একটি স্বেচ্ছাসেবকমূলক পেশা। কিন্তু পরবর্তী সময়ে আমি যখন মাস্টার্স শেষ করলাম তখন আস্তে আস্তে জানতে পারলাম যে আমি এটা পূর্ণ পেশা হিসেবে নিতে পারি। সেই ধারণা থেকে যারা প্রতিবন্ধী শিশুদের নিয়ে কাজ করে প্রথমে সেরকম একটি সংস্থায় কাজ শুরু করি। সেখান থেকে আমার মানবাধিকারকর্মী হয়ে ওঠা।

রাইজিংবিডি: ভয়েস অ্যান্ড ভিউস নামে মানবাধিকার সংস্থা তৈরি করার উদ্দেশ্যে কী?
জান্নাতুল ফেরদৌস আইভি: আমি প্রথমে চাকরি করছিলাম ২০০৫ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থায়। প্রায় ২০ হাজার জন সব ধরনের প্রতিবন্ধী ভাই-বোনদের সাথে আমার কাজের অভিজ্ঞতা হয়েছে। কিন্তু সেখানে নিজেকে খুব একা মনে হতো। মানে আমার মতো কোনো বার্ন সার্ভাইভার নেই। আমি আসলে আমার মতন যারা তাদেরকে সাথে কাজ করতে চেয়েছিলাম। সেই ধারণা থেকে ২০১৪ সালে আমি ভয়েস অ্যান্ড ভিউস নামে মানবাধিকার সংস্থা গড়ে তুলি।

 

২০১৯ সালে প্রথম এর আগে সরা বিশ্বে বার্ন সার্ভাইভারদের সাথে কেউ কোনো কাজই করেনি। আমরা ১০০ জন নারীদের নিয়ে প্রথম জরিপ করি যে তাদের মানবাধিকার পরিস্থিতি কি। যে তারা শিক্ষা সুযোগ পেয়েছে কিনা, তারা চাকরি সুযোগ পেয়েছে কিনা, পেলো তারা সেখানে কেমন ব্যবহার পায়। গণপরিবহনে উঠলে একজন বার্ন নারীর অভিজ্ঞতা কি। এই তথ্যের ওপর আমরা জরিপ করি। জরিপের তথ্যগুলোর ভিত্তিতে আমরা কি পরিমাণ মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়, কি ধরনের বৈষম্য হয় এই ধরনের তথ্যগুলো আমরা সংগ্রহ করেছি। জেলা পর্যায়ে জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে সচেতনতা বৃদ্ধির কাজ করছি, আস্তে আস্তে আমারা জাতীয় পর্যায়ে কাজ করবো।

রাইজিংবিডি: লেখালেখি ও শর্ট ফিল্ম নির্মাণের শুরুটা কেমন ছিল?
জান্নাতুল ফেরদৌস আইভি: আমার পরিবারের ভালোবাসা, সহমর্মিতা, মানসিক শক্তি পেয়ে এই দুর্ঘটনা কাটিয়ে উঠেছি। এক সময় মনে হলো এটাই একটা গল্প হতে পারে, আমার মতো সবার অনুপ্রেরণা পাওয়া উচিত। সেই ভাবনা থেকেই উপন্যাস লেখা শুরু।

 

আর আমার শর্ট ফিল্ম নির্মাণের গল্পটা উল্টো। ফিল্ম হলো আমার প্রতিবাদের ভাষা। আমরা কর্মক্ষেত্রে সব সময় সমান সুযোগ পাই না। সাধারণত ব্যবস্থাপনা জায়গায় নারীদের অংশগ্রহণ সুযোগ কম। এটা আমাকে খুব কষ্ট দিয়েছিলো। যে আসলে এটা ঠিক না। সেই জায়গায় থেকে আমার প্রথম ফিল্ম তৈরি করা। সেই সময়ে আমি ব্যাপক সাড়া পেয়েছি। দেশি-বিদেশি বিভিন্ন ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে দেখানো হয়েছে। এটার জন্য আমি তিনটি মানবাধিকার সংস্থা থেকে পুরস্কার পেয়েছি। আমার সব ফিল্মে নারী হচ্ছে মূল চরিত্র।

রাইজিংবিডি: যখন শুনলেন বিবিসির ১০০ প্রভাবশালী নারীর তালিকায় আপনার নাম এসেছে তখন অনুভূতি কেমন ছিল?
জান্নাতুল ফেরদৌস আইভি: বিবিসি থেকে আমার কাছে ফোন আসাটা অপ্রত্যাশিত ছিল।  প্রথমে আমি ভাবছি যে এখানে তো অনেকের নাম থাকবে সেখানে আমারটা থাকবে কি, থাকবে না সেটা আমি নিশ্চিত ছিলাম না। ২১ নভেম্বর যখন শুনলাম আমার নাম আছে তখন আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। আসলে এটা আমার কাজের একটি অনন্য স্বীকৃতি। ধন্যবাদ বিবিসিকে বিশ্বের ১০০ প্রভাবশালী নারীর তালিকায় আমাকে স্থান করে দেওয়ার জন্য।

 

রাইজিংবিডি: আপনার মতো যারা আছেন তাদের জন্য আপনার পরামর্শ-
জান্নাতুল ফেরদৌস আইভি: নারীদের বলবো একবার যদি কোনো দুর্ঘটনা ঘটে সাধারণভাবে সবাই ধরে নেয় ওর জীবনটা ওখানেই শেষ। কিন্তু আমি বলব যে যতক্ষণ আল্লাহ আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছে ততক্ষণ পর্যন্ত জীবনটা অনেক আনন্দের এবং জীবনটা খুব সুন্দর। সেটা যদি আমাদের একটা অংশ কম থাকে যেমন আমার দুটো হাত একসাথে করতে পারতাম না তখন অসংখ্যবার কাঁদতাম। কিন্তু দুটো হাত যখন একসাথে করে দেখতাম আমার হাত পোড়া কিন্তু আমার হাত তো আছে। কাজ করতে পারছি। আমার যতটুকু কমতি ছিল আমি মেনে নিয়েছিলাম। সবাইকে আমি বলব আমাদের যেটা নেই সেটা নিয়ে আমাদের মন খারাপ করার কোনো দরকার নেই। যেটা আছে সেটা নিয়ে আনন্দিত হই।

রাইজিংবিডি: সময় দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।
জান্নাতুল ফেরদৌস আইভি: আপনাদেরকেও অসংখ্য ধন্যবাদ।

ভিডিও লিংক