দুই মহাদেশের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ জয় করেছেন জাফর সাদেক


admin প্রকাশের সময় : ডিসেম্বর ১৬, ২০২৩, ৩:০৭ পূর্বাহ্ন /
দুই মহাদেশের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ জয় করেছেন জাফর সাদেক

মাউন্ট এলব্রুস ও কিলিমানজারোর চূড়ায় বাংলাদেশর জাতীয় পতাকা হাতে জাফর সাদেক

প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে মাত্র ১৫ দিনে ইউরোপ মহাদেশের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ এলব্রুস এবং আফ্রিকা মহাদেশের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ কিলিমানজারো জয় করেছেন জাফর সাদেক। মাউন্ট এলব্রুসের উচ্চতা ৫ হাজার ৬৪২ মিটার (১৮ হাজার ৫১০ ফুট) এবং মাউন্ট কিলিমানজারোর উচ্চতা ৫ হাজার ৮৯৫ মিটার (১৯ হাজার ৩৪১ ফুট)।

 

জাফর সাদেকের জন্ম কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার ভাটগাঁও গ্রামে। তিনি রাষ্ট্রায়ত্ত রূপালী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে কর্মরত। ঢাকা কলেজে বাংলা সাহিত্যে অধ্যয়নের সময় ভ্রমণের দিকে আকৃষ্ট হন তিনি। বাংলাদেশের পাহাড়গুলোতে ঘোরাঘুরি করে পর্বতারোহণে মনোনিবেশ করেন। তার লক্ষ্য—সাত মহাদেশের সাতটি সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গে অভিযান করা। তারই অংশ হিসেবে গত ২৭ জুলাই থেকে ১১ আগস্ট পর্যন্ত মাত্র ১৫ দিনে ইউরোপের এলব্রুস এবং আফ্রিকার কিলিমানজারো জয়ের মাধ্যমে সেভেন সামিটের প্রথম পদক্ষেপ শেষ করেছেন তিনি।

এর আগে এত অল্প সময়ে বাংলাদেশের কেউ মাউন্ট এলব্রুস এবং কিলিমানজারো পর্বতশৃঙ্গে উঠতে পারেননি। ২০২৪ সালে দক্ষিণ আমেরিকার সর্বোচ্চ পর্বত একঙ্কাগুয়া এবং ওশেনিয়া মহাদেশের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ কারস্টেন পিরামিডে অভিযানের পরিকল্পনা আছে জাফর সাদেকের।

 

চলুন, জাফর সাদেকের মুখে শুনি মাউন্ট এলব্রুস ও মাউন্ট কিলিমানজারোর চূড়ায় পা রাখার অভিজ্ঞতা।

মাউন্ট এলব্রুস:
সেভেন সামিটের প্রথম পদক্ষেপের অংশ হিসেবে গত জুলাই মাসের ২১ তারিখ ইউরোপ এবং আফ্রিকা মহাদেশের দুটো সর্বোচ্চশৃঙ্গ জয়ের উদ্দেশ্যে বের হন জাফর। ২৪ ঘণ্টা বিরতিহীন ভ্রমণ শেষে রাশিয়ার এলব্রুস সিটির ছিগেটের স্নো লেপার্ড হোটেলে আপাতত যাত্রাবিরতি। এখানে সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ভেতরে পিচঢালা পথের দুই পাশে পাইনগাছের সারি। এর চতুর্দিকে সর্পিলাকারে বয়ে চলেছে আজাউ হিমবাহের বরফগলা বকসান নদী। চার পাশে সুউচ্চ পর্বতের চূড়ায় বিকেলের নরম রোদ প্রতিফলিত হয়ে নয়নাভির দৃশ্যের অবতারণা করেছে। এই সৌন্দর্যের টানে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অভিযাত্রীরা এখানে ভিড় করেন।

 

আমার এবারের গন্তব্য ইউরোপ মহাদেশের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ এলব্রুস। এলব্রুস জর্জিয়ার সীমান্তের কাছে রাশিয়ার কাবারডিনো বলকানিয়া রিপাবলিকের পশ্চিম ককেশাস পর্বতমালার সর্বোচ্চ চূড়া। এটি ইউরোপ মহাদেশেরও সবচেয়ে উঁচু শৃঙ্গ। মূল অভিযানে যাওয়ার আগে অতি উচ্চতায় ট্রেকিং করে আবহাওয়ার সাথে শরীরকে অভিযোজন করতে হয়। অতি উচ্চতায় পাতলা বাতাসে অক্সিজেনের পরিমাণ কম থাকে। ফলে, ফুসফুসে অক্সিজেনের পরিমাণ কম থাকায় নানা রকম শারীরিক জটিলতা দেখা দেয়। এজন্য পর্বতারোহীদের ‘ক্লাইম্ব হাই, স্লিপ লো’ নিয়ম মেনে চলতে হয়।

গত ২৩ জুলাই সকালে রুকস্যাক কাঁধে ছিগেট পাহাড়ের দিকে বেরিয়ে এলাম। মৃদু বাতাসে শরীর ও মন আন্দোলিত। পথের চার পাশে রঙ-বেরঙের ফুলের সমারোহ। জর্জিয়ার সীমান্তঘেঁষা কোকোতাইবা পর্বতের নিচে একটা জলপ্রপাত বয়ে চলেছে। অন্য পাশে গ্লেশিয়ার লেক। এই লেকের পাশ দিয়ে দুই ঘণ্টা ট্রেকিং শেষে ১০ হাজার ৫০ ফুট উচ্চতার ছিগেটের চূড়ায় পৌঁছে আজকের হাইকিংয়ের সমাপ্তি।

 

দ্বিতীয় দিন আজাউ হিমবাহের পাদদেশে ১২ হাজার ৫০০ ফুট উচ্চতার এলব্রুস লেকের পাশে হাইকিং করলাম। এই হিমবাহ থেকে বকসান নদীর উৎপত্তি। এক্লামেটাইজ হাইকিং শেষে ২৫ জুলাই এলব্রুস পর্বতের হাইক্যাম্প গ্যারা বাসিতে পৌঁছালাম। চমৎকার রৌদ্রোজ্জ্বল আবহাওয়ার ফলে ককেশাস পর্বতমালার চূড়াগুলো জ্বলজ্বল করছিল। আমাদের পাঁচ সদস্যের টিমের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন আলেকজান্ডার এলেক্স। আইসবুট, আইসএক্স, হারনেস, ক্রাম্পনসহ পর্বতারোহণের টেকনিক্যাল গিয়ার পরিহিত অবস্থায় রোপের সাথে এঙ্কর করে এলব্রুস পর্বতের দক্ষিণ প্রান্তে শোল্ডার পর্যন্ত উঠে পুনরায় বেসক্যাম্পে ফিরে এলাম। দলের সবাই এক লাইনে আর গাইড এলেক্স সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন।

বেজ ক্যাম্পে প্রত্যাবর্তনের পর এলেক্স আবহাওয়ার খোঁজ-খবর নিয়ে আমাদের জানিয়ে দিলো, আজকে রাতেই সামিটের জন্য পারফেক্ট উইন্ডো। তাই সন্ধ্যা ৬টায় ডিনার সেরে আমাদের বিশ্রামের পরামর্শ দিলো। শুক্লপক্ষের পঞ্চমী তিথিতে এলব্রুস হাইক্যাম্পে সাজ সাজ রব শুরু হয়ে গেছে। দলে দলে অভিযাত্রীরা বেরিয়ে এসেছে। আকাশে এক ফালি চাঁদ। তার আলোয় ককেশাস পর্বতমালার গিরিশিরাগুলো জ্বলজ্বল করছিল। নিচে আজাউ গ্লেসিয়ার গলে সর্পিলাকারে বয়ে চলা বকসান নদী। চরাচরের গহীন নিরবতায় কান পাতলেই তার কলকল ধ্বনি শোনা যায়। জর্জিয়া-রাশিয়ার সীমান্তে এশিয়া থেকে ইউরোপকে বিচ্ছিন্নকারী দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ককেশাস পর্বতমালার সর্বোচ্চ শৃঙ্গ আমায় হাতছানি দিয়ে ডাকছে। বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়ে আমাকে যেতে হবে এলব্রুসের চূড়ায়।

 

২৭ আগস্ট রাত দ্বিপ্রহরে আমরা সামিটের জন্য তৈরি হয়ে হাইক্যাম্প থেকে বেরিয়ে এলাম। বাইরের তাপমাত্রা হিমাঙ্কের নিচে মাইনাস ১৮/২০! তার সাথে তীব্র বাতাস মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আইসবুটে ক্রাম্পন বাঁধার জন্য হাতের গ্লাভস খুলতেই ঠান্ডায় হাতটা জমে গিয়েছে। এই হাত দিয়ে কোনোভাবেই ক্রাম্পনের ফিতা শক্ত করে বাঁধতে পারছি না। দূর থেকে এলেক্স এটা বুঝতে পেরে বলল, ‘দ্রুত গ্লাভস পড়ে নাও, আমি বিষয়টা দেখছি।’

রাত ২টার দিকে এলব্রুস সামিটের উদ্দেশে রওয়ানা দিলাম। মাশরুমের মতো নরম বরফের ওপর দিয়ে খাড়া উপড়ে ওঠার কষ্ট বোঝানো কঠিন। দাঁতে দাঁত চেপে বরফের দেয়াল বেয়ে গন্তব্যের দিকে ছুটছিলাম। কয়েকশ পর্বতারোহী দলে দলে ভাগ হয়ে একই গন্তব্যে ঊর্ধশ্বাসে ছুটছে। রাতের আঁধার শেষে পূর্বাকাশে আবির রঙের খেলা চলছে। সূর্যোদয়ের প্রাক্কালে নিস্তব্ধ প্রকৃতি তার রঙ-রূপ আর সৌন্দর্যের ডালি মেলে ধরেছে। এই সৌন্দর্যের উৎস কোথায়, কেউ জানে না।

 

ককেশাস পর্বতমালায় সেদিন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সূর্যোদয়ে দৃশ্য অবলোকন করার সময় প্রমিথিউসের কথা মনে পড়ল। পৌরাণিক কাহিনী মতে, স্বর্গ থেকে আগুন চুরি করে মানব সভ্যতাকে এগিয়ে দেওয়ার অপরাধে প্রমিথিউসকে শিকলে বেঁধে ককেশাস পর্বতে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। প্রতিদিন সকালে একটা ঈগল প্রমিথিউসের বুক ছিড়ে কলিজা বের করে নিয়ে যায়। রাতে পুনঃপ্রতিস্থাপন করা হয়। এভাবেই অনন্তকাল চলবে। এসব ভাবনার মধ্যে আমি এলব্রুসের পাদদেশে পৌঁছে গেলাম। এখানে অভিযাত্রীদের জটলা। ৪০০ মিটার ফিক্সড রোপে ক্যারাবিনার মাধ্যমে নিজেকে আটকে রিজলাইন ধরে চূড়ার দিকে সাবধানে এগিয়ে যেতে হবে। এই এলাকায় প্রায়ই বরফধ্বসের কারণে পর্বতারোহীগণ দুর্ঘটনায় পতিত হণ। একটু পা হড়কালেই কয়েক হাজার ফিট নিচে পতন হওয়ার আশঙ্কা। ফিক্সড রোপ থেকে নিজেকে মুক্ত করতেই দেখি, একটা টিম চূড়ায় উঠে গেছে। এই সেই কাঙিক্ষত গন্তব্য। বহুদিনের স্বপ্ন পূরণের স্থান থেকে আমি মাত্র কয়েক কদম দূরে। রুকস্যাক থেকে লাল-সবুজের পতাকাটা আইসএক্সে বেঁধে উড়িয়ে দিলাম। কয়েক কদমের দূরত্ব যেন শেষ হয় না। সময় এখানে থমকে গেছে! সবকিছু ধীর গতিতে চলছে। ২৭ জুলাই সকাল ৯টা ৩৮ মিনিটে আমি ৫ হাজার ৬৪২ মিটার (১৮ হাজার ৫১০ ফুট) উচ্চতায় এলব্রুসের চূড়ায় পৌঁছালাম। এ যেন এক মিলনমেলা! যুদ্ধজয়ের পর রণাঙ্গনের সৈন্যরা যেমন আনন্দে লাফিয়ে ওঠেন, তেমনই বিভিন্ন দেশের অভিযাত্রীরা একে অন্যকে অভিবাদন জানিয়ে নিজ নিজ দেশের পতাকা হাতে ফটাফট কিছু ছবি তুলে সময়টাকে বন্দি করে রাখার বৃথা চেষ্টা করছিলাম। কে যেন কানে কানে বলে গেলো, এখানে থেমো না, যেতে হবে বহুদূর। সত্যিই তো বহু পথ এখনো বাকি। দ্রুত নেমে আমাকে যেতে হবে আফ্রিকার পথে।

মাউন্ট কিলিমানজারো:
এলব্রুস অভিযান শেষে পরবর্তী গন্তব্য আফ্রিকা মহাদেশের সর্বোচ্চ পর্বত কিলিমানজারো। কিলিমানজারো পূর্ব আফ্রিকার তানজানিয়া-কেনিয়া সীমান্তে অবস্থিত একটা সুপ্ত আগ্নেয়গিরি। কিলিমানজারো পর্বতের পাদদেশ থেকে শীর্ষ পর্যন্ত পাঁচটি ভিন্ন জলবায়ু স্তর দেখা যায়। পাদদেশের সন্নিকটে আবহাওয়া নাতিশীতোষ্ণ এবং বছরজুড়ে স্থিতিশীল থাকে। প্রায় ১ হাজার ৮০০ মিটার উচ্চতা পর্যন্ত চাষাবাদযোগ্য আবহাওয়া বিদ্যমান। এর পর শুরু হয় রেইনফরেস্ট স্তর। এখানের তাপমাত্রা কিছুটা উষ্ণ এবং বায়ু আর্দ্র থাকে। প্রায় ২ হাজার ৮০০ মিটার উচ্চতার পর শুরু হয় জলাভূমি জলবায়ু স্তর। রেইনফরেস্ট থেকে এর বাতাস শুষ্কতর এবং তাপমাত্রা কম। এর পর থেকে প্রতিটি স্তরে তাপমাত্রা কমতে থাকে এবং বাতাস শুষ্ক হতে থাকে। ৪ হাজার মিটার উচ্চতায় শুরু হয় মরু জলবায়ু। এখানে প্রাণের কোনো নামগন্ধ নেই। ৫ হাজার মিটার থেকে পর্বতের চূড়া পর্যন্ত আর্কটিক জলবায়ু স্তর বিদ্যমান। এই স্তর পাথুরে এবং বরফে আচ্ছাদিত। এমন বিচিত্রভাবে স্তরে স্তরে জলবায়ুর ভিন্নতা একে অনন্য করে তুলেছে। কিলিমানজারোর আরেকট বিচিত্র বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এই পর্বতে যাওয়া জন্য ছয়টি রুট আছে। প্রতিটি রুটের শুরুতে রেইন ফরেস্ট তারপর মোরল্যান্ড এবং সর্বশেষ আল্পাইন ডেজার্ট পেরিয়ে কিলিমানজারোর চূড়ার পাদদেশে হাইক্যাম্প থেকে সামিটের উদ্দেশ্যে যেতে হয়।

প্রাচীন যুগ থেকে কিলিমানজারো পর্বত অঞ্চলে বিভিন্ন জাতি বসবাস করে আসছে। ওয়াকোনিঙ্গো, বান্টু পিগমিসহ আরও কয়েকটি ক্ষুদ্র জাতি এখানে বসতি স্থাপন করেছিল। একসময় উম্বু জাতির আক্রমণে ওয়াকোনিঙ্গোরা এখান থেকে পালিয়ে যায়। এখানে ওয়াঙ্গাসা নামক আরেকটি জাতির স্থাপনা পাওয়া যায়। আদিকাল থেকে এরা কিলিমানজারো অঞ্চলে বসবাস করছে, এমন দাবি করে এই জাতি। তার পর ৪০০ বছর পূর্বে এখানে ওয়াচাগা জাতির আগমন ঘটে। বহু বছরের যুদ্ধ, বিবাদের পর একসময় এরা সকলে এক নেতার নেতৃত্বে চাগা জাতি হিসেবে একতাবদ্ধ হয়।

কিলিমানজারোতে ছিল বাংলাদেশ-ভারতের যৌথ অভিযান। ১ আগস্ট মস্কো থেকে তানজানিয়ার পথে বের হওয়ার আগেই খবর পেলাম, ইতোমধ্যে ঢাকা থেকে মুজিব ভাই এবং কলকাতা থেকে লক্ষ্মী দিদি তানজানিয়ার রাজধানী দার-এস-সালামে পৌঁছেছেন। এয়ারপোর্ট থেকে সরাসরি মোশি শহরে এসে আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত হলো মারাঙ্গু গেট দিয়ে আমরা কিলিমানজারো আরোহণ করব।

আমাদের তিন সদস্যের অভিযাত্রীর সাথে প্রধান গাইড ছিল মোদি। তার সাহযোগী হামিদ এবং তিনজন পোর্টার, পাচকসহ সাত সদস্যের সাপোর্ট স্টাফ। ৭ আগস্ট সকাল ১০টায় মারাঙ্গু গেট থেকে মানদারা হাটে যাওয়ার সময় পুরো পথটা ছিল বৈচিত্র্যময় রেইন ফরেস্ট। এত ঘন জঙ্গল যে, কোথাও কোথাও সূর্যালোক পৌঁছাতে পারে না। সাদা বানর, হনুমান আর পাখির কিচিরমিচির গানে চারপাশ মাতোয়ারা। বন্য প্রাণিরা ঝিরিতে পিপাসা নিবারণে মত্ত। তাদের কোনোদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। জলপ্রপাতে গড়িয়ে পড়া জলের শব্দ সঙ্গীতের দ্যোতনা সৃষ্টি করেছে।

রেইন ফরেস্ট পেরিয়ে দ্বিতীয় দিনের গন্তব্য হরম্বো হাট। এখানে মোরল্যান্ড প্রকৃতিতে এক আশ্চর্য রঙের খেলা। গাছপালা সাইজে ছোট হয়ে গেছে। বাহারি ফুল ফুটে আছে। কখনো মেঘ এসে সবকিছু ঢেকে দিচ্ছে। দৃষ্টিসীমায় কিছুই দেখা যায় না ।মোরল্যান্ড পাড়ি দিয়ে চলে আসলাম আল্পাইন ডেজার্ট এরিয়ায়। বৃক্ষহীন বিরান মরুভূমিতে মুক্তভাবে দাঁড়িয়ে আছে উহুরু পর্বতচূড়া, অন্য পাশে পাথুরে মাওয়েনজি পর্বত। ১০ আগস্ট পড়ন্ত বিকেলে ৪ হাজার ৭৫০ মিটার উচ্চতায় কিবো হাটে পৌঁছালাম। রাংগাই এবং মারাঙ্গুর পথে যারা এসেছে, তাদের সবার হাইক্যাম্প কিবো হাট। তাই, এখানে অভিযাত্রীদের জটলা তুলনামূলক বেশি। মোদি চৌকস গাইড এবং আমুদে প্রকৃতির লোক। তার কাছ থেকে তানজানিয়ার ওয়াকোনিঙ্গো, বান্টু পিগমি, উম্বু, ওয়াঙ্গাসা, চাগাসহ বিভিন্ন উপজাতির ইতিহাস, আফ্রিকান উপকথা, কিংবদন্তি এবং রূপকথার গল্প শোনা হয়েছে।

এখন পর্যন্ত তানজানিয়ার ইতিহাসে সবচেয়ে বড় জাতিগোষ্ঠী হিসেবে চাগা জাতির নাম উচ্চারিত হয়। জার্মান উপনিবেশকালে এই জাতির সদস্যরা পশ্চিমা সংস্কৃতির স্পর্শে অনেকটাই নিজস্ব রীতি-ঐতিহ্য থেকে সরে আসে। তবে, এখনও এরা নিজেদের চাগা হিসেবে পরিচয় দেয়। চাগা সমাজে সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ হচ্ছে কলা এবং কফি। বহুকাল ধরে প্রাচীন বিনিময় প্রথা প্রচলিত থাকলেও বর্তমানে এরা মুদ্রাভিত্তিক বাণিজ্য করা শুরু করেছে।

বিকেল হলেই অভিযাত্রীদের মনোরঞ্জনের জন্য গাইড-পৌর্টাররা গানের আসর জমাতো। নাচ-গানের মাধ্যমে অতি উচ্চতায় ট্রেকিংয়ের ক্লান্তি ভুলে যেতাম। ডিনারের পর মোদি জানালো, আজকে রাতেই আমরা সামিটে যাব। চারদিকে সাজ সাজ রব উঠেছে। মধ্যরাতে হাইক্যাম্প থেকে বেরিয়ে দেখি, চাঁদের আলোয় ঝলমল করছে চারপাশ। হাজার হাজার মাইল দূর থেকে নক্ষত্রেরা মিটিমিটি জ্বলছে। হেডল্যাম্পের আলোতে অভিযাত্রীরা ছুটছে আপন গন্তব্যে। গিলমান্স পয়েন্টের সামনে দাঁড়িয়ে সূর্যোদয়ের দৃশ্য অবলোকন করছিলাম। এই সৌন্দর্যের বর্ণনা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। ২০০মিটার ট্রেকিং করলেই গন্তব্যে পৌঁছে যাব। গিলমান্স থেকে স্টেলা পয়েন্ট, গ্লেশিয়ার পেরিয়ে ১১ আগস্ট স্থানীয় সময় সকাল ৯টা ৩৬ মিনিটে ৫ হাজার ৮৯৫ মিটার (১৯ হাজার ৩৪১ ফুট) উচ্চতায় অবস্থিত কিলিমানজারোর সর্বোচ্চ পয়েন্ট উহুরু পর্বতের চূড়ায় পৌঁছলাম।

এলব্রুস থেকে কিলিমানজারো—দীর্ঘ পথের পরিক্রমা। মাত্র পনের দিনে ইউরোপ ও আফ্রিকা মহাদেশের দুটি সর্বোচ্চ পর্বতের চূড়ায় আরোহণ বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কঠিন বিষয়। আমি সেই চ্যালেঞ্জটা নিয়েছি বলেই হয়ত প্রকৃতি সদয় হয়ে আমায় গন্তব্যে পৌঁছানোর সকল বন্দোবস্ত করে দিয়েছিল।