‘বাবা ঘরে আসুক, কারাগার থেকে ফিরুক মা’


admin প্রকাশের সময় : নভেম্বর ২৯, ২০২৩, ১:২৩ পূর্বাহ্ন /
‘বাবা ঘরে আসুক, কারাগার থেকে ফিরুক মা’

নির্বাচন কী, রাজনীতি কী—এসব বোঝার এখনো বয়স হয়নি ছোট্ট নূরজাহানের। তার কাছে আন্দোলন, মানববন্ধন, নির্দলীয় কিংবা নাশকতার মতো শব্দগুলো বেশ কঠিন, অপরিচিতও। কোনটির কী অর্থ, তা বোঝা দূরের কথা, এসব শব্দ ঠিকমতো উচ্চারণই করতে শেখেনি সে। কোনো অনুষ্ঠানে মা–বাবা ছাড়া সে কখনো যায়নি। কিন্তু তাঁদের ছাড়াই দাদা-দাদির হাত ধরে তাকে আসতে হয়েছে উচ্চারণ করতে কষ্ট হওয়া এমন একটি আয়োজনে, যার নাম মানববন্ধন।

চার বছরের নূরজাহানের সঙ্গে তার বড় বোন আকলিমাও মঙ্গলবার দুপুরে ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধনে এসেছিল। মানববন্ধন কী, সেটি না বুঝলেও অবশ্য উচ্চারণ করতে পারে আকলিমা। তার বয়স সাত বছর। দুই বোনের মা হাফসা আক্তারকে নাশকতার একটি মামলায় গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। যে কারণে গত বৃহস্পতিবার থেকে মায়ের দেখা পাচ্ছে না তারা। আর বাবাকে দেখছে না আরও কয়েক দিন আগে থেকে। তাদের বাবা আবদুল হামিদ ভূঁইয়া বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। গত ২৮ অক্টোবর ঢাকায় বিএনপির মহাসমাবেশ পণ্ড হওয়ার পর থেকে হামিদ ভূঁইয়া গ্রেপ্তার এড়াতে বাসায় থাকছেন না।

নূরজাহান ও আকলিমার মতো মানববন্ধনে এসেছিল আরও কিছু শিশু। তাদের কারও বাবা, কারও চাচা গ্রেপ্তার হয়ে এখন কারাগারে। যে মানববন্ধনে তারা এসেছিল, সেটির নেপথ্যের আয়োজক বিএনপি। ব্যানারে অবশ্য আয়োজক হিসেবে লেখা হয় ‘রাজবন্দীদের স্বজন’। আয়োজনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে লেখা ছিল ‘গায়েবি মামলায় কারাবন্দী বিরোধী দলসমূহের নেতা-কর্মীদের মুক্তির দাবিতে মানববন্ধন ও প্রধান বিচারপতি বরাবর স্মারকলিপি পেশ’।

কারাবন্দী বিএনপির ২১ জন নেতার স্বজনেরা মানববন্ধনে বক্তব্য দেন। এ ছাড়া সংহতি জানিয়ে বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠন ও গণতন্ত্র মঞ্চের নেতারাও বক্তব্য দিয়েছেন। এই কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে মঙ্গলবার প্রেসক্লাবের সামনে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়। যতক্ষণ অনুষ্ঠান চলছিল, ততক্ষণ সেখানে পুলিশের সদস্যরা দাঁড়িয়ে ছিলেন।

বেলা ১১টায় শুরু হওয়া কর্মসূচি শেষ হয় দেড়টায়। অনুষ্ঠান চলার সময় দুপুর ১২টার দিকে পুলিশের দুজন সদস্য পেশাজীবী এক নেতাকে গিয়ে অনুষ্ঠান দ্রুত শেষ করতে অনুরোধ করেন।

অনুষ্ঠান চলার সময় শিশু নূরজাহান ও আকলিমা কখনো দাদার কোলে, কখনো দাদির কোলে বসে ছিল। তাদের দাদার বক্তব্যে বাবা ও মায়ের নাম শুনে কেঁদে ফেলে দুই শিশু। তাদের দাদি আবেদা খাতুন অনুষ্ঠান চলার সময় বারবার কাঁদছিলেন।

অন্যদিকে দুই শিশুর দাদা আবদুল হাই ভূঁইয়া মানববন্ধনে দেওয়া বক্তব্যে বলেন, তাঁর বড় ছেলে আবদুল হামিদ ভূঁইয়াকে পুলিশ খুঁজছে। না পেয়ে ছেলের স্ত্রী হাফসা আক্তারকে তুলে নিয়ে যায়। তাঁকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে তিন দিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। অথচ তাঁর বড় ছেলের স্ত্রী রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নন।

বিএনপি করা অপরাধ কি না এমন প্রশ্ন তুলে মানববন্ধনে আবদুল হাই ভূঁইয়া বলেন, ভোটের অধিকারের জন্য তাঁর ছেলেরা আন্দোলন করেছেন। এটাই কি তাঁদের অপরাধ?
আবদুল হাই ভূঁইয়া ঢাকা দক্ষিণ সিটির ৩৮ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি—এই তথ্য তিনি নিজেই মানববন্ধনে জানান। আরও বলেন, তাঁর এক ছেলে আবদুর রহিম ভূঁইয়া ঢাকা মহানগর দক্ষিণ ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক। তাঁকে একটি মামলায় দুই বছর সাজা দেওয়া হয়েছে। আরেক ছেলে আবদুর রহমান ভূঁইয়া ৩৮ নম্বর ওয়ার্ড যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক। একটি মামলায় রহমানও এখন কারাগারে। নিজের দুই ছেলে এবং আরেক ছেলের স্ত্রীর মুক্তির জন্য দুই নাতনিকে সঙ্গে নিয়ে মানববন্ধনে এসেছেন বলে জানান তিনি।

মানববন্ধন শেষে রাতে মুঠোফোনে আবদুল হাই ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর বড় ছেলে পরিবার নিয়ে থাকেন পুরান ঢাকার ফরিদাবাদে। তিনি ও তাঁর স্ত্রীসহ পরিবারের অন্য সদস্যরা থাকেন ওয়ারীতে। তিনি জানান, ঢাকার নিম্ন আদালতে ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনায় তাঁর বড় ছেলের স্ত্রীকে আসামি করা হয়েছে। দুই নাতনি এখন তাঁদের সঙ্গে থাকছে। তিনি বলেন, ‘নাতনিদের একটাই চাওয়া, তাদের বাবা ঘরে আসুক, কারাগার থেকে ফিরুক মা।’

‘একটার পর একটা মামলাই দিচ্ছে’

মানববন্ধনে ছিলেন জাতীয়তাবাদী যুবদলের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সভাপতি সাইফুল আলমের স্ত্রী মাহবুবা খানম। তিনি বক্তব্যে বলেন, তাঁর স্বামী ৯ মাস ধরে কারাগারে। সেখানে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তিনি বলেন, ‘কোন জগতে বাস করছি, একটার পর একটা মামলাই দিচ্ছে। জামিনই দিচ্ছে না। ’

ঢাকা মহানগর বিএনপির নেতা কারাবন্দী মনিরুজ্জামানের স্ত্রী শায়লা জেসমিন অভিযোগ করেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা দরজা ভেঙে তাঁর স্বামীকে বাসা থেকে নিয়ে গেছেন। স্বামীর সঙ্গে কারাগারে দেখা করতে দেওয়া হচ্ছে না বলেও অভিযোগ করেন তিনি।

বিনা দোষে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মো. শাহজাহানকে সাজা দেওয়া হয়েছে বলে মানববন্ধনে অভিযোগ করেন তাঁর স্ত্রী রহিমা শাহজাহান মায়া। তিনি বলেন, ওয়ার্ড পর্যায় থেকে কেন্দ্রীয় নেতাদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে একদলীয় নির্বাচন করার জন্য।

বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারের অনুরোধ জানান তিনি।
ঢাকা মহানগর বিএনপির নেতা আবুল বাশারের স্ত্রী অভিযোগ করেন, তাঁর স্বামীকে কারাগারে অত্যাচার করে মেরে ফেলা হয়েছে। দুই সন্তান নিয়ে খুব কষ্টে আছেন। তিনি আরও বলেন, তাঁর স্বামী রাজনীতি করতেন। রাজনীতি করা অপরাধ কি না—এ প্রশ্ন তোলেন তিনি।

যেসব মামলায় পুলিশ সাক্ষী, পুলিশই বাদী—সেসব মামলা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন ঢাকা মহানগর উত্তর যুবদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক এস এম জাহাঙ্গীরের স্ত্রী রাজিয়া আক্তার। তিনি অভিযোগ করেন, মিথ্যা মামলায় তাঁর স্বামীর বিরুদ্ধে রায় দেওয়া হয়েছে।

মানববন্ধনে আরও বক্তব্য দেন বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা হাবিবুর রহমানের স্ত্রী শাহানারা, ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির আহ্বায়ক আমান উল্লাহর ভাতিজি মার্জিয়া আক্তার প্রমুখ। এ ছাড়া সংহতি জানিয়ে বক্তব্য দেন নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি, গণ অধিকার পরিষদের (একাংশ) সভাপতি নুরুল হক প্রমুখ।

পেশাজীবী নেতাদের মধ্যে বক্তব্য দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএনপিপন্থী শিক্ষকদের সংগঠন সাদা দলের আহ্বায়ক অধ্যাপক লুৎফর রহমান, ইউনিভার্সিটি টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ইউট্যাব) প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক এ বি এম ওবায়দুল ইসলাম, প্রকৌশলী রিয়াজুল ইসলাম, কবি আবদুল হাই শিকদার, সাংবাদিক নেতা রুহুল আমিন গাজীসহ অনেকে। মানববন্ধন সঞ্চালনা করেন সাংবাদিক নেতা কাদের গনি চৌধুরী।

‘কিংস পার্টিতে যোগ দিতে চাপ’

মানববন্ধনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান অভিযোগ করেন, দলের ভাইস চেয়ারম্যান শাহজাহান ওমরকে সরকারের তৈরি করা একটি কিংস পার্টিতে যোগ দিতে চাপ দেওয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, শাহজাহান ওমরের পরিবারের সদস্যরা তাঁকে বিষয়টি জানিয়েছেন।

শাহজাহান ওমর একটি মামলায় এখন কারাগারে।
মানববন্ধনে সভাপতির বক্তব্যে জাতীয়তাবাদী মহিলা দলের সভাপতি আফরোজা আব্বাস অভিযোগ করেন, ছাত্রলীগ-যুবলীগের হাতে হাতকড়া দিয়ে দেওয়া হয়েছে। তারা বিএনপির নেতা-কর্মীদের ধরে পুলিশের হাতে দিচ্ছে। অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে দেওয়া হচ্ছে না।

আফরোজা আব্বাসের স্বামী বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসও এখন কারাগারে।

স্মারকলিপি দেওয়ার পথে বাধা

মানববন্ধন শেষে কারাবন্দী নেতাদের স্বজনেরা প্রধান বিচারপতি বরাবর স্মারকলিপি জমা দিতে প্রেসক্লাবের সামনে থেকে হাইকোর্টের উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার পরপরই পুলিশের বাধার মুখে পড়েন। পরে স্বজনেরা প্রেসক্লাবের ভেতরে চলে যান।

গতকাল বিকেলে বিএনপির চেয়ারপারসনের মিডিয়া উইং সদস্য শায়রুল কবির খান সাংবাদিকদের জানান, পাঁচ পৃষ্ঠার স্মারকলিপি কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে প্রধান বিচারপতির সুপ্রিম কোর্টের ঠিকানায় পাঠানো হয়েছে।

কারাবন্দীদের স্বজনদের পক্ষে মহিলা দলের সভাপতি আফরোজা আব্বাসের সই করা স্মারকলিপিতে বলা হয়, বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় এক অসহনীয় পরিস্থিতিতে কারাবন্দী বিরোধী রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের পরিবারের সদস্যরা প্রধান বিচারপতির দ্বারস্থ হতে বাধ্য হয়েছেন।

এতে বলা হয়, গত ২৮ অক্টোবর বিএনপির মহাসমাবেশের চার-পাঁচ দিন আগে থেকে এখন পর্যন্ত মোট ৪৩৫টির বেশি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় ১৭ হাজারের বেশি নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। স্মারকলিপিতে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া, মহাসচিব মির্জা ফখরুলসহ ৮৯ জন কারাবন্দী ও সাজাপ্রাপ্ত নেতার তালিকা দেওয়া হয়েছে।  

স্মারকলিপিতে বলা হয়, দেশের সর্বোচ্চ আদালত বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট বিচারপ্রার্থীদের শেষ আশ্রয়স্থল। প্রধান বিচারপতির অবগতির জন্য সাতটি বিষয় স্মারকলিপিতে তুলে ধরা হয়। এতে অভিযোগ করা হয়েছে, বর্তমান সরকার হয়রানি ও ষড়যন্ত্রমূলক মিথ্যা গায়েবি মামলাকে বিরোধী দল দমনের প্রধান অবলম্বনে পরিণত করেছে। এ কাজে রাষ্ট্রের পুলিশ ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থাকে দলীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে যথেচ্ছ ব্যবহার করছে। সরকার ও সরকারি দল বিচার বিভাগকে তাদের অপতৎপরতার প্রধান বাহনে পরিণত করেছে বলেও স্মারকলিপিতে অভিযোগ করেছেন কারাবন্দী নেতাদের স্বজনেরা।