বিশ্বের শীর্ষ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকের মূল প্রতিষ্ঠান মেটার কাছে বাংলাদেশ সরকারের তথ্য চেয়ে অনুরোধের সংখ্যা বাড়ছে। সরকারের অনুরোধে মেটাও আগের চেয়ে বেশি সাড়া দিচ্ছে।

চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে বাংলাদেশ সরকার মেটার প্ল্যাটফর্মগুলোর ব্যবহারকারী সম্পর্কে যেসব তথ্য চেয়েছে, তার ৬৭ শতাংশের বেশি ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানটি সাড়া দিয়েছে।

পাশাপাশি ২০২২ সালের জুন থেকে ২০২৩ সালের জুন সময়কালে বাংলাদেশের আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে আড়াই হাজারের বেশি কনটেন্টে (আধেয়) ব্যবহারকারীর প্রবেশ সীমিত করেছে মেটা।

মার্কিন বহুজাতিক তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান মেটা সম্প্রতি চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটির স্বচ্ছতা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই সময়কালে বাংলাদেশ সরকার মেটার কাছে মোট ৯৮৮টি অনুরোধ করে। এর মধ্যে আইনি প্রক্রিয়ার অনুরোধ ৯৫৬টি এবং জরুরি ভিত্তিতে তথ্য দেওয়ার অনুরোধ ৩২টি। সরকার এই ৬ মাসে মেটার কাছে মোট ১ হাজার ৪৫৪টি অ্যাকাউন্ট সম্পর্কে তথ্য চেয়েছে।

প্রতিবেদন অনুসারে, উল্লিখিত ৬ মাসে বাংলাদেশ সরকারের অনুরোধের বিপরীতে ৬৭ দশমিক ২১ শতাংশ তথ্য সরবরাহ করেছে মেটা। আইনি প্রক্রিয়ায় অনুরোধের ৬৯ শতাংশ ক্ষেত্রে মেটা তথ্য সরবরাহ করেছে। জরুরি ভিত্তিতে অনুরোধের ক্ষেত্রে তথ্য সরবরাহ করেছে ৬ দশমিক ২৫ শতাংশ।

২০২২ সালের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়কালে বাংলাদেশ সরকার মেটার কাছে ৮৩৬টি অনুরোধ করেছিল। এর মধ্যে আইনি প্রক্রিয়ার অনুরোধ ৭৭২টি। জরুরি ভিত্তিতে তথ্য দেওয়ার অনুরোধ ৬৪টি। সরকার এই ৬ মাসে মেটার কাছে মোট ১ হাজার ২৭৮টি অ্যাকাউন্ট সম্পর্কে তথ্য চেয়েছে। এই সময়কালে বাংলাদেশ সরকারের অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে ৬৪ দশমিক ৮৩ শতাংশ তথ্য সরবরাহ করেছিল মেটা।

মেটা বছরে দুবার নিজেদের স্বচ্ছতা প্রতিবেদন প্রকাশ করে থাকে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশেষ করে ২০২১ সালের দ্বিতীয়ার্ধ (জুলাই-ডিসেম্বর) থেকে বাংলাদেশ সরকারের অনুরোধের পরিমাণ টানা বাড়তে দেখা গেছে।

ফৌজদারি তদন্তের জন্য বিভিন্ন দেশের সরকারের কাছ থেকে ব্যবহারকারীর অ্যাকাউন্টের তথ্য সংরক্ষণের অনুরোধ পেয়ে থাকে মেটা। চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে বাংলাদেশ সরকার এমন ২৮টি অনুরোধে ৪০টি অ্যাকাউন্টের তথ্য সংরক্ষণের জন্য মেটাকে বলেছিল।

চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত সময়ে মেটা বাংলাদেশ থেকে ২ হাজার ২৭০টি কনটেন্টে ব্যবহারকারীর প্রবেশ সীমিত করেছে। এর মধ্যে ২ হাজার ২৬০টি ফেসবুক পোস্ট, ১০টি ফেসবুক প্রোফাইল রয়েছে।

মেটা তার স্বচ্ছতা প্রতিবেদনে জানিয়েছে, ২০২২ সালের জুন থেকে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) রিপোর্ট করা ২ হাজার ৫৭৮টি আইটেমে বাংলাদেশ থেকে ব্যবহারকারীর প্রবেশ সীমিত করা হয়েছে। এই পদক্ষেপের কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, এই আইটেমগুলো রাষ্ট্রের নিরাপত্তা-জনশৃঙ্খলার বিরুদ্ধে যায়—এমন বিষয়বস্তু, অশ্লীল আচরণ, ধর্মীয়-সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ও মানুষের মধ্যে বৈরিতাকে উসকে দেয়, যা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮ লঙ্ঘন করে।

ব্যাপক সমালোচনার মুখে বাংলাদেশ সরকার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন রহিত করে গত সেপ্টেম্বরে সাইবার নিরাপত্তা আইন-২০২৩ প্রণয়ন করেছে।

২০২২ সালের জুন থেকে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত বিটিআরসির রিপোর্টের পরিপ্রেক্ষিতে যে পরিমাণ আইটেমে মেটা প্রবেশ সীমিত করেছে, তা আগের বছরের তুলনায় কয়েক গুণ বেশি। ২০২১ সালের জুলাই থেকে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত মেটা বিটিআরসির রিপোর্টের পরিপ্রেক্ষিতে ২৬২টি আইটেমে প্রবেশ সীমিত করেছিল।

সরকার কোন ধরনের কনটেন্টে প্রবেশ সীমিত করার অনুরোধ জানায় বা কোন ইস্যুতে ব্যবহারকারীর তথ্য চায়, তা স্বচ্ছতা প্রতিবেদনে উল্লেখ করে না মেটা। এ বিষয়ে জানতে মেটার বাংলাদেশে নিয়োগপ্রাপ্ত জনসংযোগ এজেন্সির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটির কাছে প্রশ্ন পাঠানো হয়েছিল। তবে এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত মেটার তরফ থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।

অবশ্য সরকার কোন বিষয় সরিয়ে নিতে অনুরোধ করে, তা স্বচ্ছতা প্রতিবেদনে জানায় বিশ্বের জনপ্রিয় সার্চ ইঞ্জিন প্রতিষ্ঠান গুগল। সম্প্রতি গুগল নিজেদের চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন মাসের স্বচ্ছতা প্রতিবেদন প্রকাশ করে। গুগলের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকার গুগলের কাছে মোট ৮০০টি অনুরোধ করে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৪১ শতাংশ ছিল মানহানিবিষয়ক। এরপর উল্লেখযোগ্য হলো, সরকারের সমালোচনা ৩৬ শতাংশ, পণ্য ও সেবা-সংক্রান্ত ১২ শতাংশ।

সরকারের অনুরোধে মেটার সাড়া দেওয়া বেড়ে যাওয়া প্রসঙ্গে মালয়েশিয়ার ইউনিভার্সিটি অব মালয়ার আইন ও উদীয়মান প্রযুক্তি বিভাগের জ্যেষ্ঠ প্রভাষক মুহাম্মদ এরশাদুল করিম প্রথম আলোকে বলেন, মেটা একটা ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান। মানুষের ডেটা বিক্রি করেই মেটা ব্যবসা করছে। তা ছাড়া বাংলাদেশে ব্যবসা করতে হলে মেটাকে এখানকার আইনও মেনে চলতে হবে। এসব কারণে হয়তো মেটা সরকারের অনুরোধে সাড়া বেশি দিচ্ছে। তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো স্থানীয় আইনের পাশাপাশি নিজেদের নীতিমালাও (গাইডলাইন) অনুসরণ করে থাকে। এখন মানুষ যদি নিজেকে প্রকাশ করার ক্ষেত্রে বাধা পান, তবে তাঁরা সংশ্লিষ্ট প্ল্যাটফর্ম থেকে একসময় মুখ ফিরিয়ে নেবেন।

মুহাম্মদ এরশাদুল করিম আরও বলেন, রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, জনশৃঙ্খলা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তবে এখানে প্রশ্ন হলো, সরকার কোন ক্ষেত্রে, কার ক্ষেত্রে এই বিষয়গুলো প্রয়োগ করে।